শনিবার, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১০:২৬ অপরাহ্ন
আমার সুরমা ডটকম: উত্তর-পূর্ব বাংলাদেশের সুপ্রসিদ্ধ ব্যবসা কেন্দ্র ও শিল্পাঞ্চল ছাতকের অবিসংবাদিত নেতা ও প্রগতিশীল রাজনীতির কিংবদন্তি ও ক্ষনজন্মা পুরু সাবেক এমএনএ মরহুম আব্দুল হকের। ১৯৭১ সালের ১৯ ডিসেম্বর এক সড়ক দূর্ঘটনায় মানব অধ্যায়ের যবনিকাপাত ঘটিয়ে না ফেরার দেশে চলে যান অবিসংবাদিত এ নেতা। আমৃত্যু তিনি মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি ও শোষনমুক্ত সমাজ গঠনের অধিকার আদায়ের লড়াই-সংগ্রাম করে গেছেন। একজন সাদা মনের মানুষ হিসেবে পরিচ্ছন্ন রাজনীতিই ছিল তার জীবনের অন্যতম বৈশিষ্ট। এদেশের সবকটি ঐতিহাসিক গণআন্দোলনে ছিল তার একনিষ্ট সক্রিয়তা। ৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৬৯ এর গণ-অভ্যূত্থান ও ৭১’ এর মুক্তিযুদ্ধে তিনি রেখেছিলেন গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বের সাথে নেতৃত্ব দিয়ে পাক হায়ানাদের মোকাবেলা করেন তিনি। মানুষের অধিকার আদায়ে রাজপথে লড়াই করতে গিয়ে এ মহান নেতাকে দিনের পর দিন কারাবরণও করতে হয়েছে বিভিন্ন সময়ে।
বর্তমান প্রজন্মের জন্য এমএনএ আব্দুল হক এক রাজনৈতিক ইতিহাস। সময়ের আবর্তে একজন মহান বীরের বীরত্বগাঁথা এক উজ্জ্বল ইতিহাস ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে। আব্দুল হক ১৯৩০ সালে তৎকালীন সিলেট জেলার সুনামগঞ্জ মহকুমার ছাতক থানাধীন ভাতগাঁও গ্রামের একটি সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মৌলভী আব্দুল ওয়াহিদ ও মাতা মাহেবুন নেছার অত্যন্ত ¯েœহভাজন ছিলেন তিনি। তিন ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন পরিবারে জেষ্ঠ্য সন্তান। তার মেজো ভাই মরহুম আবুল হাসনাত আব্দুল হাই ছিলেন এ অঞ্চলের একজন গণমানুষের নেতা। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ছাতক-দোয়ারা নিয়ে গঠিত সুনামগঞ্জ-৫ আসন থেকে আব্দুল হাই পরপর ৩ বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এমএনএ আব্দুল হক ১৯৫১ সালে সুনামগঞ্জ সরকারী জুবিলী হাইস্কুল থেকে মেট্টিক পাশ করে উচ্চ শিক্ষার জন্য সুনামগঞ্জ কলেজে ভর্তি হন। তিনি আইএ পাশ করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ ও এলএলবি ডিগ্রী লাভ করেন। এ সময় তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিম উলাহ হলে জিএস নির্বাচিত হন। পরে হাইকোর্টে আইন পেশায়ও নিযুক্ত হন তিনি। ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত ওয়েষ্ট এন্ড হাইস্কুলে তিনি কয়েক বছর শিক্ষকতাও করেছেন। সুনামগঞ্জের ছাত্র সমাজকে সংগঠিত করে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে আব্দুল হক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের একজন সক্রিয় কর্মী হিসেবে কাজ করেছেন। ১৯৫৫ সালে তিনি গ্রেফতার হন এবং দীর্ঘ ১৩ মাস কারাভোগ করেন। রাজপথের অগ্রসৈনিক আব্দুল হক ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামীলীগ থেকে বৃহত্তর ছাতক (ছাতক-দোয়ারাবাজার-কোম্পানীগঞ্জ) ও জগন্নাথপুর থানা নিয়ে গঠিত পাকিস্থান জাতীয় পরিষদ আসনে এমএনএ নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ কালো রাত্রীতে দেওয়ান ওবায়দুর রাজার বাড়িতে সুনামগঞ্জের প্রথম সারির নেতাদের সাথে বৈঠকে মিলিত হন আব্দুল হক। পরের দিন ২৭ মার্চ দেওয়ান ওবায়দুর রাজাকে আহবায়ক করে গঠিত হয় ১৩ সদস্য বিশিষ্ট সর্বদলীয় স্বাধীন বাংলা পরিষদ। এ পরিষদে প্রথম সদস্য ছিলেন বাংলার আরেক ক্ষণজন্মা পুরুষ কিংবদন্তী রাজনীতিবিদ সাবেক মরহুম আব্দুস সামাদ আজাদ ও দ্বিতীয় সদস্য ছিলেন আব্দুল হক। এছাড়া সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, এডভোকেট আব্দুর রইছ, আব্দুজ জহুর, সমছু মিয়া চৌধুরী, আ.লীগ নেতা হোসেন বখত, ন্যাপ নেতা আলী ইউনুছ, আব্দুল কদ্দুছ ও আলফাত উদ্দিন আহমদ স্বাধীন বাংলা পরিষদের সদস্য ছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আস্থাভাজন হিসেবে ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে ৫নং সেক্টরের বেসামরিক উপদেষ্টা ও ছাতক-জগন্নাথপুর-দিরাই’র প্রধান সমন্বয়কারীর দায়িত্ব পালন করেন আব্দুল হক। দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধ শেষে ১৬ ডিসেম্বর দেশ শত্রুমুক্ত হলেও স্বাধীনতার স্বাদ গ্রহন করা এ মহান নেতার ভাগ্যে জুটেনি। ১৯৭১ সালের ১৯শে ডিসেম্বর সিলেট-সুনামগঞ্জ রোডে মর্মান্তিক এক সড়ক দূর্ঘটনায় এমএনএ আব্দুল হক চলে যান না ফেরার দেশে। সিলেট সার্কিট হাউজে সংগ্রাম কমিটির সভা থেকে প্রাইভেট গাড়ি যোগে সুনামগঞ্জে ফেরার পথে সিলেটের টুকেরবাজার এলাকায় সড়ক দূর্ঘটনায় তিনি নিহত হন। এ সময় তার সাথে ছিলেন বর্তমান দোয়ারা উপজেলা চেয়ারম্যন ইদ্রিছ আলী বীর প্রতীকসহ আরো ক’জন নেতা। এমএনএ আব্দুল হকের অনাকাংখিত ও অকাল মৃত্যুতে তখন স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দসহ দেশের সর্বস্থরের দেশপ্রেমিক মানুষ গভীরভাবে মর্মাহত হন। ছাতক শহরে তাকে সমাধিস্থ করার দাবী উঠে স্থানীয়ভাবে। ২০ ডিসেম্বর বিশাল জানাযা শেষে ছাতক শহরের কোর্ট পয়েন্ট এলাকায় প্রবাসী কবরস্থানের পাশে তাকে চিরশায়িত করে রাখা হয়। মরহুম আব্দুল হকের জানাযায় মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধি নায়ক জেনারেল (অবঃ) আতাউল গনি ওসমানীসহ মুক্তিযুদ্ধের তরুন সংগঠক কমরেড মানিক মিয়া, মদরিছ আলী বিএ, শফিকুল হক, এমসিএ সমছু মিয়া চৌধুরী, আব্দুল ওদুদ, মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আব্দুস সালাম, আঙ্গুর মিয়া চৌধুরী, মদরিছ মিয়া চৌধুরী, তৈমুছ রাজা, মুকিত চৌধুরী, হাজী ময়না মিয়া, সমশের আলী, লুৎফুর রহমান প্রধান, হাজী আচ্ছা মিয়া, আমির আলী বাদশা প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। প্রগতিশীল রাজনীতির কিংবদন্তি ও ক্ষনজন্মা পুরুষ মরহুম আব্দুল হকের ৪৫তম মৃত্যুবার্ষিকী ছিল ২০১৭ সালের ১৯ ডিসেম্বর। তার মৃত্যুর ৪৫টি বছর এরই মধ্যে অতিবাহিত হয়ে গেছে। বরাবরের মতো এমএনএ আব্দুল হকের নামে ৪৫তম মৃত্যু বার্ষিকীতেও কোন শোকসভা কিংবা আনুষ্ঠানিকভাবে শ্রদ্ধাভরে তাকে স্মরন করতে দেখা যায়নি। তার সমাধিস্থলটি অযতেœ-অবহেলায় ঝোপ-ঝাড়ে ঢাকা পড়ে আছে। চতুর্দিকে বাসাবাড়ি, ময়লা-আবর্জনার স্তুপ ও দোকানকোটা তৈরী হওয়ায় মানুষের নজরের আড়ালে চলে গেছে তার কবরস্থানটি। অবহেলার কারনে এমএনএ আব্দুল হকের সমাধিস্থলটি এখন অস্থিত্ব হারাতে বসেছে। অনেকটা প্রচার বিমুখ হওয়া দেশপ্রেমিক এ মহান বীরের স্বাধীনতা যুদ্ধের বীরত্বগাঁতা কাহিনী হারিয়ে যাচ্ছে ক্রমেই। মরহুম এমএন এ আব্দুল হককে স্মরণীয় করে রাখতে ১৯৭২ সালে ছাতকের গোবিন্দগঞ্জে প্রতিষ্ঠা করা হয় আব্দুল হক স্মৃতি ডিগ্রী কলেজ। ৭২ পরবর্তি ২৫ বছর ছাতকের এ মহান নেতার নামে উলেখযোগ্য কিছু করতে দেখা যায়নি। দীর্ঘ ২৫ বছর ছাতকের কিংবদন্তি পুরুষ আব্দুল হক এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে তার অবদানকে রাখা হয়েছে প্রচার বিমুখ। ১৯৯৬ পরবর্তি সময়ে আওয়ামী সরকারের আমলে মুহিবুর রহমান মানিক এমপির ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় মুক্তিযুদ্ধের ৫নং সেক্টর হেড কোয়াটার বাঁশতলায় প্রতিষ্টা করা হয় এমএনএ আব্দুল হকের নামে হকনগর ও স্মৃতিসৌধ। বর্তমানে বাশঁতলা-হকনগর একটি অঘোষিত পর্যটন কেন্দ্রে পরিনত হয়েছে। সীমান্তবর্তী দৃষ্টিনন্দন হকনগর স্মৃতিসৌধ দেখতে প্রতিদিনই দুর-দুরান্ত থেকে আগত দর্শনার্থীদের ভীড়জমে। ঐতিহাসিক স্থান হিসেবে হকনগরকে একটি পূর্নাঙ্গ পর্যটন কেন্দ্রে পরিনত করতে কার্যক্রম চলছে বলে জানিয়েছেন মুহিবুর রহমান মানিক এমপি। বর্তমান প্রজন্মের কাছে এমএনএ আব্দুল হকের গৌরবোজ্জল ইতিহাস পৌছে দেয়া এখন সময়ের দাবী। সংস্কার ও সংরক্ষনের মাধ্যমে তাঁর সমাধিস্থল দৃষ্টিনন্দন করে তোলা অতীব জরুরী হয়ে পড়েছে। আগামী ২৬ মার্চের আগে প্রধান সড়কের সাথে সমাধিস্থল পর্যন্ত সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থা তৈরীসহ সর্বস্থরের মানুষকে তার কবর জিয়ারত করার সুযোগ করে দেয়া দাবী তুলেছেন স্থানীয়রা। দেশপ্রেমিক এমএনএ আব্দুল হকের নামে পাঠাগার ও স্মৃতি সংসদ গঠনের মাধ্যমে তাঁর জীবনি চর্চার সুযোগ করে নতুন প্রজন্মের কাছে মরহুম আব্দুল হককে বাঁচিয়ে রাখা সকলের দায়িত্ব ও কর্তব্য বলেও মনে করেন স্থানীয় সচেতন মহল। এ জন্যে এগিয়ে আসতে হবে স্থানীয় সংসদ সদস্য উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা, উপজেলা প্রশাসন, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ও স্থানীয় দেশপ্রেমিক সচেতন মহলসহ সবাইকে।